শায়খুল হাদীস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান – দারসে হাদীস

——درس حديث———
দারসে হাদীস
শায়খুল হাদীস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান

بسم الله الحمن الرحيم
نحمده ونصلى على رسوله الكريم.

عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه قال،قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إنما الاعمال بالنيات،وإنما لكل امرء ما نوى ا، فمن كانت هجرته الى الله ورسوله فهجرته الى الله ورسوله ،ومن كان هجرته الى دنيا يصيبها او امراءة ينكحها فهجرته الى ما هاجر اليه- متفق عليه
তরজমা: হযরত উমার বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সকল কাজের নির্ভর নিয়তের উপর।প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে তাই রয়েছে যা সে নিয়ত করেছে।সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের (সন্তুষ্টির)নিয়তে হিজরত করেছে,তাঁর হিজরত হবে আল্লাহ ও রাসূলের জন্যেই।আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার লোভে কিংবা কোন নারীকে বিয়ে করার জন্যে হিজরত করেছে, সে তাই পাবে যে জন্যে হিজরত করেছে। (বুখারী-মুসলিম।)

হাদীসের গুরুত্ব:
সব কাজের ফলাফল নির্ভর নিয়তের উপর।নিয়ত সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে যত আয়াত আছে এবং যত হাদীস বর্ণিত আছে তন্মধ্যে উল্লিখিত হাদীস সবচেয়ে স্পষ্ট ।একটি বিশেষ মূলনীতি রূপে উদাহরণ সহযোগে হাদীসটি উপস্থাপিত হয়েছে।
সহীহ বুখারী,সহীহ মুসলিম, সুনানে নাসাঈ,সুনানে আবু দাউদ,জামে তিরমিযী এবং সুনানে ইবনু মাজাহসহ নির্ভরযোগ্য অন্যান্য কিতাবেও হাদীসটি সংকলিত আছে। এমনকি ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বুখারী শরীফের পৃথক সাতটি স্থানে এ হাদীস পুনরাবৃতি করেছেন।
মুহাদ্দিসীনে কিরাম বিশাল হাদীস ভাণ্ডারের মধ্যে চারটি হাদীসকে যাবতীয় ইসলামী কার্যাবলীর উসূল বা মূলনীতি বলে গণ্য করেন । তন্মধ্যে এটি প্রথম। কোন কোন মুহাদ্দিস এ হাদীসকে نصف العلم বা ইলমের অর্ধেক অভিহিত করেছেন।

হাদীসের প্রেক্ষাপট:
মুহাদ্দিসীনে কিরাম উল্লিখিত হাদীসের তিনটি প্রেক্ষাপট চিহ্নিত করেছেন।যেমন-
এক.ইসলামের মূলনীতি সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিয়ত।সকল কাজের ফলাফল নিয়তের উপরই নির্ভরশীল।তাই সর্বক্ষেত্রে নিয়তের বিশুদ্ধতা অবলম্বনের প্রয়োজনিয়তা শিক্ষাদানের জন্য নবীজি এ হাদীস ইরশাদ করেছেন।

দুই: ইসলামপূর্ব যুগে আরব সমাজে শ্রেণিভেদ ছিলো অত্যধিক।তারা অনারব অথবা নিজেদের থেকে নিম্নস্তরের মানুষকে নেহায়েত ঘৃণার চোখে দেখতো।এরূপ লোকের সাথে কন্যা বিয়ে দেয়া কিছুতেই সমীচীন বিবেচনা করতো না।কিন্তু ইসলামের শিক্ষা দেয়া মানব মর্যাদা এবং সামাজিক সাম্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের মনের গভীর থেকে এ ঘৃণাবোধ মুছে যায়।বিশেষভাবে মদীনা শরীফ হিজরত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার ও মুহাজির সাহাবীগণের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কায়েম করে দিয়েছিলেন,এতেকরে সাহাবা সমাজ থেকে ইসলামপূর্ব যুগের শ্রেণিভেদ,বংশ গরিমা,পরনিন্দা দূরীভুত হয়ে যায়।ফলে মদীনা শরীফের বাসিন্দা আনসারগণ বহিরাগত মুহাজিরদের পূর্ণ মর্যাদা ও সন্মানের চোখে দেখতে শুরু করেন।এমনকি আনসারগণ সামাজিক সাম্যের এমন অনুপম নজির স্থাপন করেন যে,নিজ নিজ সম্পত্তি সমান ভাগ করে মুহাজিরদের দেন।শ্রেণি-গোত্র ভেদাভেদ ভুলে নিজ কন্যাদের মুহাজিরগণের সাথে বিয়ে দিতে দ্বিধা সংকোচ বোধ করেন নি।মদীনার আনসারগণের এ মহান উদারতা ও মহানোবতার সুযোগ নিয়ে সহায় সম্পত্তির লোভ এবং সম্ভ্রান্ত গোত্রে বিয়ের প্রলোভনে কারো কারো হিজরত করার সম্ভাবনা ছিলো ।এ প্রেক্ষিতেই হিজরতকালে নিয়ত বিশুদ্ধ রাখার তাগিদ দিতেই নবীজি এ হেদায়াত প্রদান করেন।হাদীসে বিবৃত আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার লোভ অথবা কোন রমনীকে বিয়ে করার নিয়তে হিজরত করে উক্তিটি সুস্পষ্ট একারণের প্রতি ইঙ্গিত করে।

তিন: ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ বুখারী শরীফের বিখ্যাত শরাহ ফাতহুল বারীতে ইমাম তাবারানী রাহিমাহুল্লাহ’র আল মু’জামুল কাবীর কিতাবের বরাতে এবং বুখারী শরীফের অন্য শরাহ ফদলুল বারী কিতাবে শায়খ জুবায়ির বিন বাক্কার রাহিমাহুল্লাহ প্রণীত আখবারুল মাদীনা,ইমাম সুয়ূতী প্রণীত মুন্তাহাল আমাল এবং ইমাম আবীদ সিন্দী প্রণীত আল মাওয়াহিবুল লাতীফাহ কিতাবত্রয়ের বরাতে একটি রিওয়াইয়াত উল্লেখ আছে যে, জনৈক ব্যক্তি উম্মে কায়িস কায়লা নাম্নী মহিলাকে বিয়ে করার গভীর আগ্রহে পয়গাম পাঠালেন।উম্মে কায়িস জানিয়ে দিলেন,আমি হিজরতের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি।তাই এক্ষুনি বিয়ে করা সম্ভব নয়। তবে তুমিও যদি হিজরত করো তাহলে তোমাকে স্বামী হিশেবে বরণ করে নেবো। ঐ ব্যক্তি তখন মদীনায় হিজরত উক্ত মহিলাকে বিয়ে করেন ।তাঁদের এ বিষয়টি অবহিত হবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত এবং অন্যান্য সমুদয় ব্যাপারে নিয়তের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্যই উল্লিখিত হাদীসখানা উপস্থাপন করেছেন।
উল্লেখ্য যে, বর্তমানে বাজারে প্রচলিত মিশকাত শরীফের একটি বঙ্গানুবাদে জনৈক টীকাকার উম্মে কায়িস’র ঘটনা সম্বলিত রিওয়াইয়াতের সনদ বা বর্ণনাসূত্র বিশুদ্ধ নয় দাবী করেছেন।তাঁর সে দাবী অমূলক। কেননা উপরোল্লিখিত কিতাবসমূহে মুহাদ্দিসীনে কিরামের নির্ধারিত উসূল বা হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ি ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।

কে ছিলেন সেই সাহাবী:
উম্মে কায়িস রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ে করার নিয়তে যিনি হিজরত করেছিলেন তাঁর প্রকৃত নাম নির্ভরযোগ্য কোন কিতাবেই পাওয়া যায় না।বুখারী শরীফের প্রায় সব শরাহ লেখক এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসে কিরাম বলেন, সেই সাহাবী মুহাজিরে উম্মে কায়িস (উম্মে কায়িসের উদ্দেশ্যে হিজরতকারি )উপাধিতে পরিচিত হয়েছিলেন।তাঁর প্রকৃত নাম কোন নির্ভরযোগ্য কিতাবে পাওয়া যায় না।বর্তমান যুগের কোন কোন লেখক তাঁর নাম আবু তালহা বলে উল্লেখ করেছেন।অথচ উম্মে কায়িস রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘটনার সাথে আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কোন সম্পর্ক নেই। সাহাবা চরিত বিষয়ক কিতাবাদিতে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে যে,আবু তালহা ইসলাম গ্রহনের পূর্বে উম্মে সুলাইম নাম্নী মহিলার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন।উম্মে সলাইম জানালেন,আপনি মুসলমান হয়ে গেলে প্রস্তাব কবুল করবো।তখন আবু তালহা ইসলাম গ্রহন পূর্বক উক্ত মহিলাকে বিয়ে করেন।

নিয়তের অর্থ ও গুরুত্ব:
আভিধানিক অর্থে নিয়ত (النية) হলো القصد বা সংকল্প করা।
নিয়তের পারিভাষিক অর্থ নিয়ে ফুকাহা মুহাদ্দিসীনের কয়েকটি উক্তি পাওয়া যায় । তন্মধ্যে সবচেয়ে পরিপূর্ণ অর্থ হলো-আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করার প্রতি মনের সংকল্প বা ইচ্ছা পোষণ করা।
নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম।কেননা শরীয়তের দৃষ্টিতে কাজের বিশুদ্ধতা এবং ফলাফল দু’টি মূলনীতি নির্ভর। প্রথমত: কাজের নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া ।দ্বিতীয়ত: কাজের পদ্ধতি শরীয়ত নির্ধারিত অথবা শরীয়ত সম্মত হওয়া।এ দু’টির কিংবা দু’টির মধ্যে যেকোন একটির ব্যতিক্রম হলে শরীয়তের মানদণ্ডে কাজ বিশুদ্ধ হবে না।সুতরাং সে কাজের কর্তা কোন সাওয়াব পাবে না।বরং গোনাহগারও হতে পারে।দু’টি উদাহরণ পেশ করলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে।যেমন-মসজিদে গিয়ে জামাতে নামায আদায়ে অত্যধিক সাওয়াবের কথা সবারই জানা।একজন লোক মসজিদে জামাতে শরীক হলো,তার নিয়ত হলো মসজিদ কিংবা মুসল্লিদের কোন সম্পদ চুরি করবে।এমতাবস্থায় সে জামাতে নামাযের সওয়াব তো পাবেই না,অশুদ্ধ নিয়তে প্রহসনমূলক নামাযের কারণে উল্টো গোনাহগার হবে।
সিজদা নামাযের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।সিজদার মাধ্যমে বান্দাহ আল্লাহ তা’লার বিশেষ কুরবত বা নৈকট্য লাভ করে।এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি আল্লাহর অধিক নৈকট্য লাভের নিয়তে যদি নামাযের প্রতি রাকাআতে পাঁচ বা সাতটি করে সিজদা করে তবে তার নামাযই শুদ্ধ হবে না।

ইবাদতের স্থরানুযায়ি নিয়তের হুকুমের পার্থক্য:
ফিকহ শাস্ত্রের পরিভাষায় ইবাদাত দুই প্রকার। যথা-
ক.ইবাদাতে মাকসু…