দারসে হাদীস শায়খুল হাদীস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান
দারসে হাদীস
শায়খুল হাদীস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান
(নিয়ত বিষয়ক হাদীসের অবশিষ্ট অংশ)
হিজরতের অর্থ ও বিধান :
হিজরত الهجرة শব্দের অাভিধানিক অর্থ الترك বা পরিত্যাগ করা।কোন স্থান বা বস্তু পরিত্যাগ করা,ইত্যাদি ।
শরীয়তের পরিভাষায় হিজরতের দু’টি অর্থ আলোচিত হয়েছে।যথা-
ক.الهجرة ترك ما نهي الله عنه হিজরত হলো আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু বর্জন করা।এ অর্থেই হাদীস শরীফে মুহাজির’র পরিচিতি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-المهاجر من هاجر ما نهي الله عنه অর্থাৎ মুহাজির হলো সে ব্যক্তি যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় বর্জন করে।
খ.দ্বীন ও ঈমানের নিরাপত্তার জন্য নিজ বাসস্থান পরিত্যাগ করে ঈমান-আমলের পক্ষে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়াকে হিজরত বলে।
উল্লেখ্য যে, ঈমান ও আমলের পক্ষে স্থায়ী নিরাপদ স্থান পাওয়া না যাওয়া পর্যন্ত সাময়িক নিরাপদ স্থানে হিজরতের বিধান রয়েছে।যেমন-মুসলমানগণের উপর মক্কার কাফেরদের নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নির্দেশে নবুওয়াত প্রকাশের ৫ম বর্ষে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে এগারোজন পুরুষ ও চারজন মহিলা আফ্রিকার হাবশায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করেন।কিছু দিন পর হযরত জাফর বিন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে বিরাশি জন হিজরত করেন।
পরবর্তীতে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য মদীনা শরীফ স্থায়ী নিরাপদ জনপদ হিশেবে গড়ে উঠলে সবাই সেখানে হিজরত করেন।
হিজরতের আসল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ বা তাঁর সন্তুষ্টি লাভের কার্যকলাপ নিরাপত্তা সহকারে প্রতিপালনের সুযোগ অনুসন্ধান করা।কারো কারো মতে কিছুকাল পরিবার পরিজন থেকে দূরে অবস্থান করে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকা কিংবা সমাজ সংস্কার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করাও এক ধরণের হিজরত। একারণে তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম’র হেরা গুহায় সাময়িক অবস্থানকে হিজরত বলে গণ্য করেন।
হিজরতের বিধান বিষয়ে আলোচনার মূল কথা হলো,হিজরতের হুকুম বা বিধান সর্বকালের জন্য বলবৎ আছে নাকি রহিত হয়ে গেছে।একটি হাদীসে উল্লেখ আছে لا هجرة بعد الفتح বা বিজয়ের পর হিজরত নেই।এর আলোকে কেউ কেউ বলেছেন, অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর হিজরতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু মুহাদ্দিসীনে কিরাম বলেন, উল্লিখিত হাদীস দ্বারা কেবল মক্কা শরীফ থেকে হিজরতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।সুতরাং অষ্টম হিজরির পর মক্কা শরীফ থেকে বাধ্যতামূলক হিজরতের প্রয়োজনিয়তা রহিত করা হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত কারণে কেউ চাইলে হিজরত করতে বাধা নেই। যেমন মক্কা বিজয়ের পর কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মুবারক সুহবত লাভের আশায় অনেকে মদীনা শরীফ হিজরত করেছেন।
উপরোক্ত আলোচনায় প্রতিয়মান হলো যে, হিজরতের মৌলিক বিধান রহিত করা হয়নি বরং সর্বকালের জন্য বলবৎ আছে। আবুদাউদ, মুসনাদে আহমাদ প্রভৃতি কিতাবে হযরত মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু সূত্রে বর্ণিত হাদীস আছে-
لا تنقطع الهجرة حتي لاتنقطع التوبة،ولا تنقطع التوبة حتى تطلع الشمس من مغربها.
অর্থাৎ তাওবার দুয়ার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হিজরত রহিত হবে না।আর পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত তাওবার দুয়ার বন্ধ হবে না।
সুতরাং কোন দেশ,কোন এলাকা ঈমান ও আমলের জন্য নিরাপত্তাহীন বিবেচিত হলে সেখানকার মুসলমানের জন্য হিজরত করা কর্তব্য।
সারকথা:
নিয়ত বিষয়ক আলোচিত হাদীসটি বাহ্যত যদিও একটিমাত্র কাজ তথা হিজরত কেন্দ্রীক বিবৃত হয়েছে।কিন্তু এর অন্তর্নিহিত মর্ম শরীয়তের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
উল্লিখিত হাদীসে সামগ্রিকভাবে কয়েকটি কথা বিবৃত হয়েছে।প্রথম কথা,একটি উসূল বা মূলনীতি ।যথা-যে কোন কাজ দ্বারা সুফল অথবা কুফল পাওয়ার নির্ভর হলো নিয়তের উপর।দ্বিতিয় কথা,উল্লিখিত মূলনীতির ফলাফল স্বরূপ।যথা-প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ি কর্মফল ভোগ করবে । তৃতিয় ও চতুর্থ কথা হলো, উল্লিখিত মূলনীতি ও এর ফলাফলের বিশ্লেষণ।যথা-কেউ যদি আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে হিজরত করে থাকে,তবে অবশ্যই সে আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টি লাভ করবে। অপরদিকে কেউ যদি দুনিয়ার কোন সম্পদ লাভের নিয়তে হিজরত করে,তবে সে দুনিয়া লাভ করবে। আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টি লাভের আশা সে করতে পারেনা।
والله ورسوله اعلم
সংকলন ও পরিমার্জন : মো.আবদুল আউয়াল হেলাল